ঢাকা ০২:৪৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন হতে পারে: উপদেষ্টা সাখাওয়াত আ.লীগ নেতারা ট্রাইব্যুনালের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন আমরা ছাত্র-জনতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে চাই : ড. মুহাম্মদ ইউনূস আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কিনা তা সম্পূর্ণরূপে জনগণের সিদ্ধান্ত: মির্জা ফখরুল ফ্যাসিস্টদের মতো কারও কথা বলার অধিকার হরণ করা হবে না : প্রেস সচিব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উদ্যোক্তা তৈরির পরিবর্তে চাকরিপ্রার্থী তৈরি করে : ড. মুহাম্মদ ইউনূস সায়েন্সল্যাবে ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ রাজধানীর দয়াগঞ্জে অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ দুধ দিয়ে গোসল করে ৩৫ আন্দোলন থেকে সরে গেলেন আহ্বায়ক শুভ গণহত্যার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো ৮ কর্মকর্তাকে

সে দিন হে মার্কেট চত্বরে যা ঘটেছিল

অাকাশ ইতিহাস ডেস্ক:

১৮৮৬ সালের ৪ মের ঘটনা। রাত ১০টার ঠিক কয়েক মিনিট পর যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। বৃষ্টির প্রথম কয়েক ফোঁটা পড়ার পরই হে মার্কেট চত্বরের বিশাল লোক সমাগমে ভাটা পড়তে শুরু করে।বিক্ষোভকারীরা যে যার মতো চলে যেতে শুরু করেন।

আটটার সময় সেখানে প্রায় তিন হাজার লোক ছিলেন। আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে তারা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।পুলিশের নৃশংসতার বিরুদ্ধে শ্রমিক নেতারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন।আগের দিন পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদেই তাদের এই বিক্ষোভের ডাক।

রাত দশটার দিকে ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হলে লোকজন কমতে কমতে মাত্র কয়েকশ অবশিষ্ট ছিলেন।বিক্ষোভের সর্বশেষ বক্তাও বক্তব্য শেষ করতে যাচ্ছিলেন।

সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হচ্ছিল।এমন সময় সেখানে এসে ১৮০ পুলিশ সদস্য উপস্থিত হয়।তারা বক্তার অবস্থান থেকে অল্প দূরত্বে এসে থামে।অবশিষ্ট জমায়েত ছত্রভঙ্গ করে দিতেই তাদের এই রণমূর্তি।

পুলিশের ক্যাপ্টেন যখন সমাবেশে হামলার নির্দেশ দেন, তখন তাদের ওপর অজ্ঞাত কেউ বোমা নিক্ষেপ করে ও গুলি চালায়।এতে সাত পুলিশ সদস্য মারা যায়। আহত হয় আরও ৬৭ জন।

পুলিশও এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে,যাতে বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোক নিহত ও দুই শতাধিক আহত হন।হে মার্কেট চত্বরের এই মর্মান্তিক ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।

এর পর শ্রমিকদের নৈরাজ্যকারী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। যাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, তাদের কেউ বোমা নিক্ষেপ কিংবা গুলি ছোড়েনি। সাতজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেন আদালত। একজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।

পরে ইলিনয়ের তখনকার গভর্নর রিচার্ড জে. ওগলেবি তাদের দুজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দেন।একজন ফাঁসিকাঠে যাওয়ার বদলে আত্মহত্যা করেন।

১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর চারজনের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।১৮৯৩ সালে ইলিনয়ের নতুন গভর্নর জন পেটার আল্টগেল্ড একজনকে ক্ষমা করে দেন। শ্রমিকরা ন্যায়বিচার পাননি বলে তিনি কঠোর সমালোচনা করেন।

শ্রমবিদ্যার অধ্যাপক উইলিয়াম জে. আডেলম্যান বলেন,হে মার্কেট চত্বরের ঘটনা শ্রমিকদের ওপর যতটা প্রভাব ছড়িয়েছে, পৃথিবীর আর কোনো ঘটনা এমনটা পারেনি, যার পরিণতি মানুষ এখনও অনুভব করছে।

তিনি বলেন, এই ঘটনা আমেরিকার পাঠ্যবইয়ে স্থান পেলেও সেখানে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। এমনকি এ ঘটনার তাৎপর্যও যথাযথভাবে বলা হয়নি তাতে।

আমেরিকায় ১৮৬১-৬৫ সালের গৃহযুদ্ধে প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক নিহত হন।সাতটি দাসনির্ভর বিচ্ছিন্নতাবাদী অঙ্গরাজ্য নিজেদের কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা নাম দিয়ে মূল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হওয়ার ঘোষণা করলে এই গৃহযুদ্ধ বাধে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় ওই সাত রাজ্য নিজেদের বিচ্ছিন্ন ঘোষণা করলে উত্তরাঞ্চল তার বিরোধীতা করে।অধিকাংশ ইতিহাসবিদ বলেন, দাসপ্রথা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেই এই বিদ্রোহ শুরু হয়।এছাড়াও মতাদর্শিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যে মতপার্থক্য তো ছিলই।

উত্তরাঞ্চলীয় দাসবিরোধী শক্তি পশ্চিমা অঙ্গরাজ্যগুলোতে এই প্রথা সম্প্রসারিত হতে বাধা দেয়।তখন দক্ষিণাঞ্চলীয় জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের আলাদা করতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কনফেডারেট গঠন করে।পরে আরও চারটি রাজ্য তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

কনফেডারেট রাজ্যগুলোর অর্থনীতি ছিল তাঁতভিত্তিক। তারা ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ফোর্ট সামটারে অবস্থানকারী আমেরিকান ইউনিয়নের একটি বাহিনীকে আক্রমণ করে বসে।

কনফেডারেটরা ভেবেছিল, ইউরোপীয়রা যেহেতু তাঁতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, তাই তাদের সমর্থন পাবেন। কিন্তু ইউরোপ শেষপর্যন্ত এগিয়ে আসেনি।তারা এ যুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে চায়নি। বরং অখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিই তাদের সমর্থন ছিল।

চার বছরব্যাপী এই যুদ্ধে কনফেডারেটরা হেরে যায়।দাসপ্রথার বিলোপ ঘটে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে উত্তরের অনেকগুলো রাজ্য কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সরে এসে শিল্পের দিকে চলে যায়।সেসব অঞ্চলের লোকজন নিউ ইয়র্ক,ফিলাডেলফিয়া ও বোস্টনের মতো বড় বড় শহরে বাস করতেন।

দাসপ্রথাকে তারা পাপ ও বেআইনি বলে ভাবতেন।অভিশপ্ত এই প্রথা যাতে পশ্চিমা রাজ্যগুলোতে ঢুকতে না পারে, সেক্ষেত্রে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে দাসপ্রথার বিলোপ চাচ্ছিলেন।

দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলো ছিল কৃষিভিত্তিক।সেক্ষেত্রে তাদের শ্রমের বড় অংশটা দাসদের কাছ থেকে পেতেন।দাসপ্রথা বিলোপের চেষ্টায় স্বভাবতই তারা ভয় পেতে শুরু করলেন,ভাবতে লাগলেন, তাদের জীবন-জীবিকা বুঝি শেষ হয়ে আসছে।

ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল এমন, উত্তরের রাজ্যগুলোর যখন দাসপ্রথার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল, দক্ষিণ তখন ব্যাপকভাবে এই রীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।তাদের কৃষিখামারে দাসদের শ্রমের বিকল্প ছিল না।

গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত মূলত সেখান থেকেই।

এতে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৩০ শতাংশ পুরুষ নিহত হয়েছিলেন।এসব রাজ্যে প্রায় ৯০ লাখ লোক বাস করতেন, যাদের মধ্যে ৩৪ লাখই ছিলেন দাস।

প্রথম লড়াইটা শুরু হয় কানসাসে, ১৮৫৪ সালে।সরকার তখন কানসাস-নেবরাসকা আইন পাস করে। সে অনুসারে রাজ্যবাসী দাসপ্রথার পক্ষে না বিরোধী তা জানতে ভোটের আয়োজন করা হয়।

দুই পক্ষেই সমর্থন ছিল সমানে সমান। এই এক বিষয় নিয়ে তাদের কয়েক বছর ধরে লড়াই চলে।রক্তক্ষয়ী ওই লড়াইকে ব্লিডিং কানসাস নামে আখ্যায়িত করা হয়।অবশেষে ১৯৬১ সালে রাজ্যটি দাসপ্রথামুক্ত হয়।

তবে এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে শেষের আঘাতটা হানেন রিপাবলিকান নেতা আব্রাহাম লিংকন।১০টি রাজ্যের ভোট ছাড়াই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দাসপ্রথার বিলোপ ঘোষণা করেন।

গৃহযুদ্ধে দক্ষিণের অনেকগুলো রাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।তাদের খামার,ক্ষেতের ফসল অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়ে যায়।স্থানীয় সরকারেও দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা।

এরপর শুরু হয় দক্ষিণের রাজ্যগুলোক পুর্নগঠনের কাজ।যেটা চলে ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত।

১৮৭০ সাল থেকে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। এ সময়ে দেশটির কারখানায় ব্যাপক উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল।

এ সময়ে কায়িক শ্রমের অভাব না হলেও শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি একেবারে বিবেচনা করা হতো না।কাজের পরিবেশও ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।১৯৮০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে দেশটিতে কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় বছরে গড়ে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছেন।

এ সময়ে শ্রমিকদের একটানা ১২ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় কারখানায় কাজ করতে হত।প্রচণ্ড তপ্ত আবহাওয়ার মধ্যে তারা শ্রম দিতেন। অতিরিক্ত তাপের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে তাদের জীবন অসাড় হয়ে পড়তো।কারখানায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ছিল না।

ধূলাবালিতে ভরা নোংরা, অরক্ষিত পরিবেশ ও বাষ্প এঞ্জিনের তাপে একনাগারে কাজ করতে গিয়ে তারা দুর্ঘটনার শিকার হতেন।

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ছিল শিশুরা।কখনো কখনো তাদের ছোট্ট আঙ্গুল মেশিনে আটকে যেতো।দীর্ঘ সময় কাজ করতে গিয়ে শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পেত না।

কারখানার বাতাসের মানও ভাল ছিল না।মেশিনগুলো যে ধোঁয়া ও বিষ উদগিরণ করতো, তার মধ্যে শ্বাস নিতে গিয়ে শ্রমিকরা কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তেন।

১৮৭০ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। যারাও বা একটু কাজ পেতেন, তাদের শ্রমের মূল্য ছিল খুবই কম।কাজেই এ সময়টায় আমেরিকার শ্রমিকদের জীবন মারাত্মক হুমকিতে পড়ে যায়।দেখা দেয় মারাত্মক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।

১৮২০ সালের দিকেই যুক্তরাষ্ট্রে শ্রম আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেশটির গৃহযুদ্ধের পর সেই আন্দোলন সবচেয়ে বেশি সফল হতে শুরু করে।

১৮৮০ সালের দিকে শ্রমিকরা বিভিন্ন ইউনিয়নের অধীন সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিভিন্ন দাবি দাওয়ার ওপর ভিত্তি করে তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৮৮৬ সালে শিকাগোর যন্ত্রপাতি উৎপাদন কোম্পানি ম্যাককরমিক হারভেস্টিং কোম্পানিতে বিক্ষোভ ডাকেন শ্রমিকরা। তারা কোম্পানির সব কাজ বন্ধ করে দেন।এর পর আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে তারা ধর্মঘট ডাকেন।

কোম্পানিতে তালা লাগিয়ে কারখানা অচল করে দেন। কিন্তু কর্মকর্তারা বিকল্প শ্রমিক সংগ্রহ শুরু করেন। ধর্মঘটের বিরোধী শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বলেন।আন্দোলনরত শ্রমিকদের তারা হামলা চালান ও হুমকি দিতে থাকেন।

ম্যাককরমিক শ্রমিকদের ধর্মঘটের সমর্থনে ওই বছর পহেলা মে বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। দুইদিন পরে কোম্পানির বাইরে এক প্রতিবাদে কয়েকজন শ্রমিক নিহত হন।এতে করে উত্তেজনা বেড়ে যায়।

এ হত্যার প্রতিবাদে হে মার্কেট চত্বরে ম্যাকরম্যােক কোম্পানির নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হলে পুলিশের নৃশংসতার শিকার হতে হয় শ্রমিকদের।

১৮৮৯ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে নিহতদের স্মরণে হে মার্কেট চত্বরের বিক্ষোভের দিনটিকে শ্রমিকদের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়।ঠাণ্ডা যুদ্ধের শুরুর দিকে কমিউনিস্ট বিরোধী চেতনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এই ছুটিকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো।

১৯৫৮ সালের জুলাইয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাউয়ার একটি প্রস্তাবে সই করেন। মে দিবসের শ্রমিকদের সঙ্গে যাতে কোনো সংহতি প্রকাশ না করা হয়, সেটা এড়াতে পহেলা মে-কে আনুগত্য দিবস ঘোষণা করে দেশটি।

প্রস্তাবে বলা হয়,পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্তকরণ ও আমেরিকান স্বাধীনতার ঐতিহ্যের স্বীকৃতির জন্য বিশেষ দিন।যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিক দিবস পালন করে সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবারে।

শ্রমিক ও তাদের পরিবারের প্রতি সম্মান ভালবাসা জানাতে পহেলা মে সবার জন্য ভাল একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হলে তারা কী করতে পারেন, হে মার্কেট চত্বরের ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

বাংলাদেশকে হারিয়ে শেষটা রাঙাতে চায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ

সে দিন হে মার্কেট চত্বরে যা ঘটেছিল

আপডেট সময় ১১:১১:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ মে ২০১৮

অাকাশ ইতিহাস ডেস্ক:

১৮৮৬ সালের ৪ মের ঘটনা। রাত ১০টার ঠিক কয়েক মিনিট পর যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। বৃষ্টির প্রথম কয়েক ফোঁটা পড়ার পরই হে মার্কেট চত্বরের বিশাল লোক সমাগমে ভাটা পড়তে শুরু করে।বিক্ষোভকারীরা যে যার মতো চলে যেতে শুরু করেন।

আটটার সময় সেখানে প্রায় তিন হাজার লোক ছিলেন। আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে তারা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।পুলিশের নৃশংসতার বিরুদ্ধে শ্রমিক নেতারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন।আগের দিন পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদেই তাদের এই বিক্ষোভের ডাক।

রাত দশটার দিকে ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হলে লোকজন কমতে কমতে মাত্র কয়েকশ অবশিষ্ট ছিলেন।বিক্ষোভের সর্বশেষ বক্তাও বক্তব্য শেষ করতে যাচ্ছিলেন।

সবকিছু শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হচ্ছিল।এমন সময় সেখানে এসে ১৮০ পুলিশ সদস্য উপস্থিত হয়।তারা বক্তার অবস্থান থেকে অল্প দূরত্বে এসে থামে।অবশিষ্ট জমায়েত ছত্রভঙ্গ করে দিতেই তাদের এই রণমূর্তি।

পুলিশের ক্যাপ্টেন যখন সমাবেশে হামলার নির্দেশ দেন, তখন তাদের ওপর অজ্ঞাত কেউ বোমা নিক্ষেপ করে ও গুলি চালায়।এতে সাত পুলিশ সদস্য মারা যায়। আহত হয় আরও ৬৭ জন।

পুলিশও এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে,যাতে বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোক নিহত ও দুই শতাধিক আহত হন।হে মার্কেট চত্বরের এই মর্মান্তিক ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।

এর পর শ্রমিকদের নৈরাজ্যকারী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। যাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, তাদের কেউ বোমা নিক্ষেপ কিংবা গুলি ছোড়েনি। সাতজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার নির্দেশ দেন আদালত। একজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।

পরে ইলিনয়ের তখনকার গভর্নর রিচার্ড জে. ওগলেবি তাদের দুজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দেন।একজন ফাঁসিকাঠে যাওয়ার বদলে আত্মহত্যা করেন।

১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর চারজনের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।১৮৯৩ সালে ইলিনয়ের নতুন গভর্নর জন পেটার আল্টগেল্ড একজনকে ক্ষমা করে দেন। শ্রমিকরা ন্যায়বিচার পাননি বলে তিনি কঠোর সমালোচনা করেন।

শ্রমবিদ্যার অধ্যাপক উইলিয়াম জে. আডেলম্যান বলেন,হে মার্কেট চত্বরের ঘটনা শ্রমিকদের ওপর যতটা প্রভাব ছড়িয়েছে, পৃথিবীর আর কোনো ঘটনা এমনটা পারেনি, যার পরিণতি মানুষ এখনও অনুভব করছে।

তিনি বলেন, এই ঘটনা আমেরিকার পাঠ্যবইয়ে স্থান পেলেও সেখানে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। এমনকি এ ঘটনার তাৎপর্যও যথাযথভাবে বলা হয়নি তাতে।

আমেরিকায় ১৮৬১-৬৫ সালের গৃহযুদ্ধে প্রায় সাড়ে সাত লাখ লোক নিহত হন।সাতটি দাসনির্ভর বিচ্ছিন্নতাবাদী অঙ্গরাজ্য নিজেদের কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা নাম দিয়ে মূল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলাদা হওয়ার ঘোষণা করলে এই গৃহযুদ্ধ বাধে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় ওই সাত রাজ্য নিজেদের বিচ্ছিন্ন ঘোষণা করলে উত্তরাঞ্চল তার বিরোধীতা করে।অধিকাংশ ইতিহাসবিদ বলেন, দাসপ্রথা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেই এই বিদ্রোহ শুরু হয়।এছাড়াও মতাদর্শিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যে মতপার্থক্য তো ছিলই।

উত্তরাঞ্চলীয় দাসবিরোধী শক্তি পশ্চিমা অঙ্গরাজ্যগুলোতে এই প্রথা সম্প্রসারিত হতে বাধা দেয়।তখন দক্ষিণাঞ্চলীয় জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের আলাদা করতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কনফেডারেট গঠন করে।পরে আরও চারটি রাজ্য তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

কনফেডারেট রাজ্যগুলোর অর্থনীতি ছিল তাঁতভিত্তিক। তারা ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ফোর্ট সামটারে অবস্থানকারী আমেরিকান ইউনিয়নের একটি বাহিনীকে আক্রমণ করে বসে।

কনফেডারেটরা ভেবেছিল, ইউরোপীয়রা যেহেতু তাঁতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, তাই তাদের সমর্থন পাবেন। কিন্তু ইউরোপ শেষপর্যন্ত এগিয়ে আসেনি।তারা এ যুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে চায়নি। বরং অখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিই তাদের সমর্থন ছিল।

চার বছরব্যাপী এই যুদ্ধে কনফেডারেটরা হেরে যায়।দাসপ্রথার বিলোপ ঘটে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে উত্তরের অনেকগুলো রাজ্য কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সরে এসে শিল্পের দিকে চলে যায়।সেসব অঞ্চলের লোকজন নিউ ইয়র্ক,ফিলাডেলফিয়া ও বোস্টনের মতো বড় বড় শহরে বাস করতেন।

দাসপ্রথাকে তারা পাপ ও বেআইনি বলে ভাবতেন।অভিশপ্ত এই প্রথা যাতে পশ্চিমা রাজ্যগুলোতে ঢুকতে না পারে, সেক্ষেত্রে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে দাসপ্রথার বিলোপ চাচ্ছিলেন।

দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলো ছিল কৃষিভিত্তিক।সেক্ষেত্রে তাদের শ্রমের বড় অংশটা দাসদের কাছ থেকে পেতেন।দাসপ্রথা বিলোপের চেষ্টায় স্বভাবতই তারা ভয় পেতে শুরু করলেন,ভাবতে লাগলেন, তাদের জীবন-জীবিকা বুঝি শেষ হয়ে আসছে।

ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল এমন, উত্তরের রাজ্যগুলোর যখন দাসপ্রথার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল, দক্ষিণ তখন ব্যাপকভাবে এই রীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।তাদের কৃষিখামারে দাসদের শ্রমের বিকল্প ছিল না।

গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত মূলত সেখান থেকেই।

এতে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৩০ শতাংশ পুরুষ নিহত হয়েছিলেন।এসব রাজ্যে প্রায় ৯০ লাখ লোক বাস করতেন, যাদের মধ্যে ৩৪ লাখই ছিলেন দাস।

প্রথম লড়াইটা শুরু হয় কানসাসে, ১৮৫৪ সালে।সরকার তখন কানসাস-নেবরাসকা আইন পাস করে। সে অনুসারে রাজ্যবাসী দাসপ্রথার পক্ষে না বিরোধী তা জানতে ভোটের আয়োজন করা হয়।

দুই পক্ষেই সমর্থন ছিল সমানে সমান। এই এক বিষয় নিয়ে তাদের কয়েক বছর ধরে লড়াই চলে।রক্তক্ষয়ী ওই লড়াইকে ব্লিডিং কানসাস নামে আখ্যায়িত করা হয়।অবশেষে ১৯৬১ সালে রাজ্যটি দাসপ্রথামুক্ত হয়।

তবে এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে শেষের আঘাতটা হানেন রিপাবলিকান নেতা আব্রাহাম লিংকন।১০টি রাজ্যের ভোট ছাড়াই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দাসপ্রথার বিলোপ ঘোষণা করেন।

গৃহযুদ্ধে দক্ষিণের অনেকগুলো রাজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।তাদের খামার,ক্ষেতের ফসল অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়ে যায়।স্থানীয় সরকারেও দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা।

এরপর শুরু হয় দক্ষিণের রাজ্যগুলোক পুর্নগঠনের কাজ।যেটা চলে ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত।

১৮৭০ সাল থেকে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। এ সময়ে দেশটির কারখানায় ব্যাপক উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল।

এ সময়ে কায়িক শ্রমের অভাব না হলেও শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি একেবারে বিবেচনা করা হতো না।কাজের পরিবেশও ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।১৯৮০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে দেশটিতে কর্মস্থলের দুর্ঘটনায় বছরে গড়ে ৩৫ হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছেন।

এ সময়ে শ্রমিকদের একটানা ১২ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় কারখানায় কাজ করতে হত।প্রচণ্ড তপ্ত আবহাওয়ার মধ্যে তারা শ্রম দিতেন। অতিরিক্ত তাপের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে গিয়ে তাদের জীবন অসাড় হয়ে পড়তো।কারখানায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ছিল না।

ধূলাবালিতে ভরা নোংরা, অরক্ষিত পরিবেশ ও বাষ্প এঞ্জিনের তাপে একনাগারে কাজ করতে গিয়ে তারা দুর্ঘটনার শিকার হতেন।

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ছিল শিশুরা।কখনো কখনো তাদের ছোট্ট আঙ্গুল মেশিনে আটকে যেতো।দীর্ঘ সময় কাজ করতে গিয়ে শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পেত না।

কারখানার বাতাসের মানও ভাল ছিল না।মেশিনগুলো যে ধোঁয়া ও বিষ উদগিরণ করতো, তার মধ্যে শ্বাস নিতে গিয়ে শ্রমিকরা কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তেন।

১৮৭০ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। যারাও বা একটু কাজ পেতেন, তাদের শ্রমের মূল্য ছিল খুবই কম।কাজেই এ সময়টায় আমেরিকার শ্রমিকদের জীবন মারাত্মক হুমকিতে পড়ে যায়।দেখা দেয় মারাত্মক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।

১৮২০ সালের দিকেই যুক্তরাষ্ট্রে শ্রম আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু দেশটির গৃহযুদ্ধের পর সেই আন্দোলন সবচেয়ে বেশি সফল হতে শুরু করে।

১৮৮০ সালের দিকে শ্রমিকরা বিভিন্ন ইউনিয়নের অধীন সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিভিন্ন দাবি দাওয়ার ওপর ভিত্তি করে তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৮৮৬ সালে শিকাগোর যন্ত্রপাতি উৎপাদন কোম্পানি ম্যাককরমিক হারভেস্টিং কোম্পানিতে বিক্ষোভ ডাকেন শ্রমিকরা। তারা কোম্পানির সব কাজ বন্ধ করে দেন।এর পর আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে তারা ধর্মঘট ডাকেন।

কোম্পানিতে তালা লাগিয়ে কারখানা অচল করে দেন। কিন্তু কর্মকর্তারা বিকল্প শ্রমিক সংগ্রহ শুরু করেন। ধর্মঘটের বিরোধী শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বলেন।আন্দোলনরত শ্রমিকদের তারা হামলা চালান ও হুমকি দিতে থাকেন।

ম্যাককরমিক শ্রমিকদের ধর্মঘটের সমর্থনে ওই বছর পহেলা মে বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। দুইদিন পরে কোম্পানির বাইরে এক প্রতিবাদে কয়েকজন শ্রমিক নিহত হন।এতে করে উত্তেজনা বেড়ে যায়।

এ হত্যার প্রতিবাদে হে মার্কেট চত্বরে ম্যাকরম্যােক কোম্পানির নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দেয়া হলে পুলিশের নৃশংসতার শিকার হতে হয় শ্রমিকদের।

১৮৮৯ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে নিহতদের স্মরণে হে মার্কেট চত্বরের বিক্ষোভের দিনটিকে শ্রমিকদের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়।ঠাণ্ডা যুদ্ধের শুরুর দিকে কমিউনিস্ট বিরোধী চেতনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এই ছুটিকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো।

১৯৫৮ সালের জুলাইয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাউয়ার একটি প্রস্তাবে সই করেন। মে দিবসের শ্রমিকদের সঙ্গে যাতে কোনো সংহতি প্রকাশ না করা হয়, সেটা এড়াতে পহেলা মে-কে আনুগত্য দিবস ঘোষণা করে দেশটি।

প্রস্তাবে বলা হয়,পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্তকরণ ও আমেরিকান স্বাধীনতার ঐতিহ্যের স্বীকৃতির জন্য বিশেষ দিন।যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিক দিবস পালন করে সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবারে।

শ্রমিক ও তাদের পরিবারের প্রতি সম্মান ভালবাসা জানাতে পহেলা মে সবার জন্য ভাল একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হলে তারা কী করতে পারেন, হে মার্কেট চত্বরের ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।